একসময় যে সমাজ আমাকে অপয়া বলতো, আজ সেই সমাজের অনুপ্রেরণা আমি! 

  • ফারজানা আক্তার
  • সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২১

অনুক্তা ঘোষাল! অনেক গুনে গুণান্বিত একজন ভারতীয় নারী। একজন মডেল, মোটিভেশনাল স্পিকার, অভিনেত্রী,উপস্থাপিকাও রেডিও জকি। একজন নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথে নানান রকম প্রতিকূলতা থাকে। কতশত প্রতিকূলতা পার হয়ে এতসব গুনের অধিকারিণী হয়েছেন আজ সেই গল্পই তার কাছ থেকে জানবো। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ফারজানা আক্তার। 

ওমেন্সকর্নার : কেমন আছেন ? ব্যস্ততা কেমন এখন ?

অনুক্তা ঘোষাল :  আমি খুব ভালো আছি। আসলে জীবনে যে কোন পরিস্থিতিতে আমি পজিটিভ থাকার চেষ্টা করি। আর আমি মনে করি পজিটিভ থাকলেই জীবনে সবচেয়ে ভালো থাকা যায়। এই মুহূর্তে মডেলিং, উপস্থাপনা, রেডিও সবকিছু নিয়ে বেশ ব্যস্ততার সাথেই দিন কাটছে।

ওমেন্সকর্নার : ছোটবেলায় বড় হয়ে কী হতে চেয়েছিলেন ?

অনুক্তা ঘোষাল : ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল মডেল হওয়ার। আর সেই স্বপ্নকে জড়িয়ে ধরে আজ এতটা পথ এগিয়ে আসা।

ওমেন্সকর্নার : জীবনের প্রথম ইনকাম কোন পেশা থেকে করে ছিলেন ? এবং কত টাকা ?

অনুক্তা ঘোষাল : জীবনে প্রথম ৩০০০ টাকা আয় করেছিলাম মডেলিং করে।

ওমেন্সকর্নার : এতসব প্রফেশনে যুক্ত আছেন। ম্যানেজ করেন কিভাবে ?

অনুক্তা ঘোষাল : আমি একটা কথা খুব বিশ্বাস করি। কোন কাজকেই কাজ মনে হয় না যদি সেই কাজটাকে ভালোবাসা যায়। আর আমার কাজই আমার ভালোবাসা। তাই ম্যানেজ করতে কখনোই কোন সমস্যা হয়নি।

আরো পড়ুন : নিজের সমস্যার সাথে কিভাবে মোকাবেলা করবেন ?

ওমেন্সকর্নার :  ক্যারিয়ারের শুরুটা কেমন ছিলো ? একটু বিস্তারিত বলবেন। 

অনুক্তা ঘোষাল : আমার জীবনে অনেক রিজেকশন রয়েছে। মানুষ রিজেক্ট হওয়ার কথা বলতে চায়না। তবে আমার জীবনে প্রতিটা রিজকশন আমাকে লড়াই করে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। প্রতিটা রিজেকশন আমাকে বাস্তবটাকে চিনে নিতে সাহায্য করেছে এবং আমাকে আরও মজবুত করেছে। আমার জেদ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রায় কুড়িটারও বেশি প্রজেক্ট থেকে আমাকে বাতিল করা হয় এসময়। তবু হার মানিনি। 

আমি বুঝতে পারি আমার মতো মেয়ে যে কখনো কোনও অনুচিত কিছুর  সাথে কোনভাবেই  আপস করেনি তার জীবনের লড়াইটা অনেক বেশি কঠিন হবে। তাই এক কথায় বলতে পারি কেরিয়ারের শুরুতে অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে। এছাড়া জীবনের এক বিশেষ পর্যায় আমাকে জীবনের প্রকৃত অর্থ বুঝতে সাহায্য করেছে। ২০১৩ সালের শেষের দিকে হঠাৎ যখন গুরুতর নার্ভের রোগে সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী হয়ে পড়ি,আমার জীবনটা মুহূর্তের মধ্যে থমকে দাঁড়ায়। সেই সময়ে হাঁটাচলা এমনকি ভালোভাবে কথা বলাও বন্ধ হয়ে যায়।

এসময়ে ডাক্তার জানায় আমি আর কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব না। আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরা আমাকে ‘অপয়া’, ‘অপাহিজ’,’বাবা মায়ের বোঝা’,’আনলাকি’ বলে ডাকত। রোজ সকালে মা আমার প্রিয় স্টিলেটোটা এনে আমার সামনে রেখে বলত আমাকে আবার উঠে দাঁড়াতে হবে। আমি চেষ্টা শুরু করি উঠে দাঁড়ানোর। এইসময় আমার কাউন্সেলিং চলছিল। তাই পাড়ায় নতুন নাম হয়েছিল ‘পাগল’।  

দেড় বছরের চেষ্টায় নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াই। ভাবি লড়়াই বুঝি শেষ। কিন্তু ওটাই ছিল শুরু। কেউ আমাকে তাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন পর্যন্ত করত না। সবাই বলত বাড়ির বোঝাটাকে বিদায় কর। মায়ের চোখে জল দেখতাম রোজ। একদিন ঠিক করি আর হারব না। পড়াশোনা শুরু করি।একদিন পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নিজের জোরে গ্র্যাজুয়েশন,পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ও এম বি এ কমপ্লিট করে বিশ্বের সেরা একটি অডিট ফার্মে (বিগ ফোর) চাকরির সুযোগ পাই। পাশাপাশি শুরু হয় টেলিভিশন অ্যাংকারিং ও মডেলিং। যুক্ত হই সমাজ সেবা মূলক কাজের সাথে। আর এভাবেই সমস্ত  প্রতিকূলতার মধ্যেও আমি জীবনে শুধু এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছি।

আরো পড়ুন : অন্যের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা কিভাবে কমাবেন ?

ওমেন্সকর্নার : পরিবার থেকে কেমন সাপোর্ট পেয়েছেন ?

অনুক্তা ঘোষাল : জীবনে আমি নিজের সিদ্ধান্ত সবসময় নিজেই নিয়েছি। আর তাও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। তবে একটা কথা সত্যি একটা খুব সাধারণ মেয়ে যখন বড় স্বপ্ন দেখে তখন তাকে জীবনে একটা নয় একাধিক লড়াই এর সম্মুখীন হতে হয় । যখন সদ্য কিশোরী তখন মডেল ও অভিনেত্রী হতে চেয়েছিলাম। আত্মীয়স্বজন, পরিবারের সদস্যরা তা কিছুতেই মেনে নেয়নি। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তাই বড় স্বপ্ন আমার জন্য নয়, এমনটাই বলা হয়েছিল আমাকে। 

২০১২ সালে কলকাতার এক নামকরা বিউটি কনটেস্টে লুকিয়ে নাম দেই। এই সময়ে শুধু পাশে ছিল অসুস্থ মা। তবে জীবনের প্রকৃত প্রাপ্তি সেদিন হয়েছিল যেদিন যে বাবা দীর্ঘ পাঁচ বছর আমার প্রফেশনকে সমর্থন করেননি তিনিই আমার স্ট্রাগল দেখে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তবে একথাও বলতে ভালো লাগে যে পরবর্তীকালে যাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছি সে প্রতি পদক্ষেপে আমার পাশে থেকেছে, প্রতি মুহূর্তে আমাকে সমর্থন করেছে।

ওমেন্সকর্নার : কোন কাজটা আপনি ব্যক্তিগতভাবে বেশি উপভোগ করেন ?

অনুক্তা ঘোষাল : মডেলিং, টেলিভিশন অ্যাংকারিং, রেডিও প্রেসেন্টিং সবই আমার সমানভাবে ভালোবাসার কাজ। 

আরো পড়ুন : জীবনে পজিটিভিটির গুরুত্ব কতখানি ?

ওমেন্সকর্নার : কাজ নিয়ে ভবিষৎ পরিকল্পনা কী ?

অনুক্তা ঘোষাল : অভিনয় নিয়ে পড়াশোনা করেছি। ইতিমধ্যে একটি ওয়েব সিরিজেও কাজ করেছি। তাই আগামী দিনে মডেলিং, টেলিভিশন অ্যাংকারিং, রেডিও প্রেসেন্টিং এর পাশাপাশি অভিনয় নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে।

ওমেন্সকর্নার : জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তের কিছু কথা কথা শেয়ার করুন। 

অনুক্তা ঘোষাল : ৯ বছরে‌ ১১টা নামকরা বিউটি কনটেস্টে জয়ী হয়েছি। প্রতিটা টাইটেল অর্জন করা আমার কাছে অন্যতম প্রাপ্তি।  বিভিন্ন নামকরা সংবাদপত্র থেকে শুরু করে বড় বড় ম্যাগাজিনে নামসহ নিজের ছবি খুঁজে পেয়েছি। বড় ব্র্যান্ডের ক্যালেন্ডারও ছেপেছে আমার ছবি দিয়ে। সমাজ সেবামূলক কাজের জন্যও সম্মানিত হয়েছি।

২০১৯ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে রেডিও প্রেসেন্টরের ভূমিকায় নিযুক্ত হয়েছি।২০২১ সালে ডায়লগ ইন, এইসময় সংবাদপত্র, পত্রভারতী, 91.9 ফ্রেন্ড্স এফ এম নিবেদিত গ্লোবাল বেঙ্গলি লিটারেচর ফেস্টে কবিতা বিভাগে তৃতীয় হয়েছি যেখানে সমগ্র বিশ্বের ৫ লক্ষ  সাহিত্যিক যোগদান করেছিলেন। এই সকল প্রাপ্তি আমার কাছে আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

ওমেন্সকর্নার : যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নারীরা খুব বেশিদূর আগাতে পেরেছে ?

অনুক্তা ঘোষাল : যুগের সাথে তাল মিলিয়ে অনেক নারী জীবনে যেমন এগিয়ে যাচ্ছে তেমনি সঠিক সুযোগ-সুবিধার অভাবে অনেক নারীর স্বপ্ন অধরাই থেকে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের সমাজের প্রতিটা মানুষকে প্রতিটা নারীর স্বপ্নকে সম্মান করতে শিখতে হবে। প্রতিটা নারীর স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করতে হবে। 

ওমেন্সকর্নার : যেসব নারীরা মিডিয়ায় কাজ করতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে কিছু পরামর্শ দিন। 

অনুক্তা ঘোষাল : সুন্দর করে কথা বলতে পারাও একটা শিল্প। আর আমার মনে হয় মিডিয়াতে কাজ করতে গেলে যে যে বিষয়গুলোর কথা মনে রাখতে হবে তার হল দেশ ও বিশ্বের সমস্ত খবর সম্পর্কে নিজেকে আপডেটেড রাখা, তাৎক্ষণিক বুদ্ধির প্রয়োগ করা, নিজের ভাবনার পরিসরকে বিস্তৃত করা এবং সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ গুছিয়ে কথা বলতে পারা।

আরো পড়ুন :  ভালোবাসার স্কেল সম্পর্কে সঠিক ধারণা আছে ? বিস্তারিত পড়ুন 

ওমেন্সকর্নার : যেসব নারীরা এখনো ক্যারিয়ার নিয়ে সচেতন নয় তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।

অনুক্তা ঘোষাল : আমি মনে করি জীবনে নিজেকে ভালবাসলে তবেই অন্যকে ভালোবাসা যায়। নিজেকে ভালো রাখলে তবেই অন্যকে ভালো রাখা যায়। আর প্রত্যেক নারীর উচিৎ নিজে স্বাবলম্বী হওয়া কারণ একজন নারী জীবনে স্বাবলম্বী হলে তবেই স্বাধীন ও সুন্দর জীবন যাপন করতে পারেন।তাই প্রত্যেক নারীর উচিৎ কেরিয়ার সম্পর্কে সচেতন হওয়া।
 

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Comment